মানিকগঞ্জে বৃক্ষ প্রেমিক শাহজাহানের সবুজ বিপ্লবের কাহিনী


ছায়া-সুনিবিড়-নিভৃত পাখি ডাকা গ্রাম মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের কৌড়ি গ্রাম। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই সুশৃঙ্খল বৃক্ষরাজি। গাঁয়ের আঁকা বাঁকা পথের দুপাশে ফলদ, বনজ ঔষধি বৃক্ষে পূর্ণ সবুজের সমাহার। যেন শিল্পীর পটে আঁকা এক ছবি। এমন নজরকারা বৃক্ষের সাজে সজ্জিত দৃশ্য; অদৃশ্য সূতোর টানে মায়াবী প্রকৃতির প্রতি গেঁথে যায় যে কোন মানুষের মনে গভীর ভালোবাসা। নয়নাভিরাম এই সবুজ বিপ্লবের এমন সাফল্য গাঁথার রচয়িতা গ্রামেরই সন্তান শাহজাহান বিশ্বাস।
মানুষের কতোই না শখ থাকে। ঘুরে বেরানো, গান শোনা, টিভি দেখা, ব্যবসা করা, আকাশে চড়া আরো কত কি। কিন্তু মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার কৌড়ি গ্রামের শাহজাহান বিশ্বাসের শখ গাছ লাগানো। গাছের সাথেই যেন তার সব শখ্যতা, গাছই যেন সংসার, গাছের সাথেই তার মিতালী। তিনি যেন গাছকেই বেশি ভালোবাসেন। আর তাই এলাকায় তিনিগাছ শাহজাহাননামেই পরিচিত।

শাহজাহান বিশ্বাসের বৃক্ষের প্রতি শখ্যতা শুরু ১৯৭৯ সালের দিকে। সেই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সড়ক, খালের পাড়, গ্রামের কাঁচা পথের দুধারে বনায়ন স্বেচ্ছায় গোরস্থান, শ্মশান, বাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানে এবং অন্যের পতিত জমিতে ৬০ হাজারের অধিক গাছের চারা রোপণ করছেন। শুধু চারা রোপণ করেই তার কাজের সমাপ্তি হয় না। চারা পরিচর্যা, পানি দেয়া, আগাছা পরিষ্কার করা, বেড়া দেয়া থেকে শুরু করে পরিপূর্ণ বৃক্ষে পরিণত করা পর্যন্ত যাবতীয় কাজগুলো তিনি ৩৭ বছর ধরে নিয়মিতভাবেই করে যাচ্ছেন অতি যতেœ সাথে।
সুন্দর পরিবেশ রক্ষায় মানিকগঞ্জের এই বৃক্ষ প্রেমিকশাহজাহান বিশ্বাসতার নিজ কর্মগুণে হয়ে উঠেছেন অন্যন্য, পেয়েছেন খ্যাতি আর মানুষের ভালোবাসা। সরজমিন ঝিটকার কৌড়ি এলাকার গিয়ে দেখা গেছে- স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা মসজিদসহ রাস্তার দুপাশে বিভিন্ন প্রকারের গাছ রোপণ করছেন তিনি। তার দেখাদেখি কৌড়িসহ আশপাশের গ্রামের প্রায় সকলেই তাদের বাড়ির আঙিনায় গাছ রোপণ করছেন।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার কৌড়ি এলাকার মৃত ওবায়দুদ বিশ্বাসের ছোট ছেলে ৬২ বছর বয়সী শাহজাহান বিশ্বাস। সকলের কাছে যিনিগাছ শাহজাহাননামে পরিচিত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দেশের জন্য পাক বাহীনির বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশকে স্বাধীন করেন এই লড়াকু সৈনিক। এরপর ১৯৭৬ সালে ভ্রমণের জন্য চলে যান দেশের বাইরে সিংঙ্গাপুর মালয়েশিয়া। এরপর দীর্ঘদিন বিদেশ ভ্রমণ শেষে ১৯৭৯ সালে আবার চলে আসেন নিজ গ্রাম কৌড়িতে। এসে তিনি নিজ অর্থে প্রথমে গ্রামের স্কুল, কলেজ মাদ্রাসা এরপর রাস্তার দুপাশে শুরু করেন গাছ রোপণ। প্রথমদিকে কিছু প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয় তাকে। শুরুর দিকে শাহজাহানের পরিবার সমাজের কেউ ভালোভাবে নেয়নি কাজটি। গাছ প্রেমী শাহজাহান তবুও থেমে যাননি, তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যান। আজও তিনি নিঃস্বার্থভাবে একের পর এক গাছ রোপণ করে চলেছেন। পর্যন্ত ৬০ হাজারের অধিক গাছ রোপণ করেছেন এই গাছ প্রেমী। এদিকে বৃক্ষ প্রেমী শাহজাহান বিশ্বাসকে অনুসরণ করে হরিরামপুর উপজেলার কৌড়িসহ আশপাশের গ্রামের ছোট বড় অনেকেই তাদের বাড়ির আঙ্গিনায় রোপণ করছেন আম, জাম, লিচু, লেবু মালটাসহ নানান রকমের ফলের গাছ। আশেপাশের কয়েকটি এলাকার মানুষ প্রায় ২০ লক্ষের বেশি গাছ রোপণ করেছেন।

প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য গাছ রোপণ করতে হয়, জীবনের নানা প্রয়োজনে, নানা সংকটে এই গাছই যে কতভাবে উপকারে আসে মানুষের তা বোঝাতে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন বৃক্ষ প্রেমীগাছ শাহজাহান কৌড়ি এলাকার পুরোগ্রামের রাস্তার দুপাশে গাছ লাগানোর কারণে মানিকগঞ্জসহ আশেপাশের জেলার মানুষের কাছে এই স্থানটি দর্শনীয় হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। কারণে চলচ্চিত্র পরিচালক এবং টিভি নাট্যকাররা তাদের চলচ্চিত্র নাটকের বেশিরভাগ সুটিং করতে আসছেন এই সবুজ গ্রামে। এই গ্রামের সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্য সেগুন, মেহগনি, আকাশমনি, নিম, হরতকি কাঠবাদামসহ বিভিন্ন প্রকারের বৃক্ষ রোপণ করা হচ্ছে কৌড়ী গ্রামের আকাবাঁকা মেঠো পথে।
সোনাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মফিজুল ইসলাম বলেন, “আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন স্কুলের মাঠে খেলতে নামতে পারতাম না রোদের কারণে। শাহজাহান ভাই নিজ উদ্যোগে স্কুলের চারপাশে বিভিন্ন প্রকার গাছ রোপণের কারণে ছায়া পড়ছে স্কুল মাঠে। ফলে স্কুলের বাচ্চারা ছায়ার মধ্যে খেলাধুলা করতে পারছে।এম রউফ ডিগ্রী কলেজের সহকারি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, “আপনারা কৌড়ি গ্রামের প্রত্যেকটি রাস্তায় হাটলে দেখতে পারবেন রাস্তার দুই পার্শ্বে সবুজ গাছ আর গাছ। এই গাছ সবুজগুলো দিয়ে যেন এই গ্রামটি সাজানো। গ্রামে গাছ শাহজাহান নামের একজন ব্যক্তি আছেন, যিনি এই গাছগুলো নিঃস্বার্থ ভাবে রোপণ করেছেন। আর যেভাবে গাছের যতœ করেছেন তিনি মনে হয় যেন গাছই শাহজাহান ভাইয়ের সন্তান।গাছ রোপণের ফলে গ্রামের সৌর্ন্দয বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনিভাবে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে অক্সিজেন প্রয়োজন তা এখান থেকে তৈরি হচ্ছে।
কৌড়ি গ্রামের তাহেজ মিয়া বলেন, “রাস্তার পাড়ে আমার ১১ শতাংশ জায়গা আছে। আর সেই রাস্তার পাশে শাহজাহান ভাই ১০ বছর আগে ১৪টি গাছ রোপণ করছিলেন। গত বছর সেই ১৪টি গাছ বিক্রয় করে আমি একটি জায়গা ক্রয় করে বাড়ি করেছি। মেয়ের বিয়ে দিছি। আমার মতো আরো অনেকে শাহজাহান ভাইয়ের রোপণ করা গাছ বিক্রয় করে নিজেদের অনেক প্রয়োজন মিটিয়েছেন।

বৃক্ষ প্রেমিকগাছ শাহজাহানবলেন, “স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছি আর সেই স্বাধীনতা আনছি ঠিক আছে। স্বাধীকার অর্জন করতে গেলে তো অনেক পরিশ্রম করা প্রয়োজন। উদ্ভিদ আর প্রাণী এমনভাবে জড়িত ওরা ছাড়া আমরা নিরুপায়, আমরা ছাড়া ওরা নিরুপায়। মানুষ তো প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ উদ্ভিদ প্রয়োজন সেইভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তাহলে তো এই দেশ এক সময় মরুভুমি হয়ে যাবে।তিনি আরও বলেন, “আমি যে ভাবে গাছ রোপণ করছি বাংলাদেশের প্রত্যেকটি শাহজাহানরা এইভাবে যদি গাছ রোপণ করতো তাহলে আমরা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হয়ে যেতাম।তিনি বলেন, “গাছও একটা ইন্ডাষ্ট্রিজ, সারা দেশে যদি এভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ি গাছ রোপণ করা হয় তাহলে কোন অভাব থাকবে না। এই দেশের প্রাকৃকিত ভারসাম্য কখনো নষ্ট হতো না।শাহজাহান বিশ্বাস আবেগে আপ্লুত হয়ে আরো বলেন, “মানব কল্যাণে কিছু করার মধ্যে যে প্রশান্তি তা কোটি টাকা দিয়ে পাওয়া সম্ভব না। আমি যখন আমার গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হেটে যাই তখন দেখি গাছের ছায়ার নিচে বসে অনেক কৃষক বিশ্রাম নিচ্ছে তখন মনে হয় আমি সফল। আমার নতুন প্রজন্মের প্রতি একটাই আহ্বান সোনার বাংলাদেশ গড়তে গেলে সবুজের বাংলাদেশ গড়তে হবে।
এই বিষয়ে জেলা বন কর্মকর্তা মনির হোসেন বলেন, “শাহজাহান বিশ্বাসের গাছ লাগানোর এমন খবরটি আমরা জানতে পেরেছি। তার এই মহৎ উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। শাহজাহানের মতো দেশের মানুষ এভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ি গাছ রোপণ করলে সবুজে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে আমাদের তেমন সময় লাগবে না। রাষ্টীয় স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য শাহজাহান বিশ্বাসের এমন মহৎ কাজের কথা সরকারকে জানানো হবে।এই কাজ আরো গতিশীল করতে শাহজাহান বিশ্বাসকে সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিলেন এই বন কর্মকর্তা।


SHARE

About Arifur Rahman

    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 Post a Comment:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন